প্রাগৈতিহাসিক যুগ
পৃথিবীর বুকে মানুষের উদ্ভব থেকে শুরু করে লিখিত উপাদানের প্রাপ্তিকালের পূর্ববর্তী সময়কালকে বলা হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগ (Pre-Historic Age)। এই সময় কোন লিখিত উপাদান পাওয়া না যাওয়ায় এ যুগের মানুষের ব্যবহৃত হাতিয়ার, বাসস্থান, মৃৎশিল্প, গৃহস্থালির সরঞ্জাম প্রভৃতি অর্থাৎ কেবলমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ওপর ভিত্তি করেই এ যুগের ইতিহাস রচিত হয়। ভারতে হরপ্পা সভ্যতার পূর্বের কোনো লিখিত ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায়নি বলে প্রাক্-হরপ্পা যুগ ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগ। প্রাগৈতিহাসিক যুগকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়-
- প্রস্তর যুগ(Stone Age)
- ব্রোঞ্জ যুগ(Bronze Age)
- লৌহ যুগ(Iron Age)
প্রস্তর যুগ (Stone Age) :-
প্রস্তর যুগের মানুষ তাদের হাতিয়ার ও ব্যাবহার্য সামগ্রি পাথর দিয়ে বানাত তাই এই যুগকে প্রস্তর যুগ বলা হয়। প্রস্তর যুগকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়-
- প্রাচীন প্রস্তর যুগ(Palaeolithic Age)
- মধ্য প্রস্তর যুগ(Mesolithic Age)
- নব্য প্রস্তর যুগ(Neolithic Age)
প্রাচীন প্রস্তর যুগ(Palaeolithic Age) :-
সময়কাল : আনুমানিক ২৫০০০০ থেকে ১০০০০ খ্রিস্টপূর্ব
নিদর্শন: প্রাচীন প্রস্তর যুগের নিদর্শন ভারতের সর্বত্র পাওয়া যায় শুধুমাত্র সিন্ধু ও গাঙ্গেয় উপত্যকার উর্বর সমভূমি ছাড়া। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থান হল-
- গুজরাটঃ নর্মদা/সবরমতি উপত্যকা
- অন্ধ্রপ্রদেশঃ কুরনুল গুহা, নেল্লুর, রেনুগুন্ডা
- মহারাষ্ট্রঃ পাটনে, নেভাসা, চিকরি, নন্দিপাল্লে
- কর্নাটকঃ হাংসি উপত্যকা
- কাশ্মীরঃ পাহলগাম
- রাজস্থানঃ দিদওয়ালা, বাগোর, বুদ্ধপুস্কর, কড়মানি
- উত্তরপ্রদেশঃ সোন ও বেলান উপত্যকা, ভীমবেটকা
যন্ত্রপাতি: প্রাচীন প্রস্তর যুগের হাতিয়ার ছিল আয়তনে অনেক বিশাল এবং তাতে কোন সোন্দর্য ও মসৃণতা ছিল না। প্রাচীন প্রস্তর যুগের হাতিয়ার গুলির মধ্যে ছিল ব্লেড বা লম্বা চিলকা প্রভৃতি। তারা একই হাতিয়ার দিয়ে মাংস কাটা, কাঠ কাটা ও শিকার ধরার কাজ করত। এই হাতিয়ারগুলি কোয়ার্জাইট নামক শক্ত পাথর দ্বারা তৈরী হত। এই যুগের মানুষকে “কোয়ার্জাইট ম্যান” বলা হত। চেন্নাই-এর আতিরাম পক্কম নামক গ্রাম থেকে প্রাগৈতিহাসিক হাতকুঠার আবিষ্কৃত হয় ।
জীবনযাত্রা:এই সময় মানুষ নদীর তীরবর্তী অঞ্চল, পাহাড়ের পাদদেশে উন্মুক্ত মালভূমি অঞ্চল ও গুহায় বসবাস করত। এদের স্থায়ী বাসস্থান ছিল না। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে, তারা যাযাবর জীবন যাপন করত। বনের ফল, লতা গুল্ম ও পশুর মাংস খেয়ে তারা জীবন ধারণ করত। এই যুগের মানুষ কৃষিকার্য, পশুপালন ও আগুন জ্বালাতে জানত না। এ যুগের মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রাহক, খাদ্য উৎপাদক নয়।
এযুগে ভারতে নেগ্রিটো জাতির মানুষ অধিক সংখ্যক ছিল। আধুনিক হোমোসেপিয়েন্স মানুষের প্রথম আবির্ভাব ঘটে প্রাচীন প্রস্তর যুগে ।
মধ্য প্রস্তর যুগ(Mesolithic Age):-
সময়কাল : আনুমানিক ১০০০০ থেকে ৬০০০ খ্রিস্টপূর্ব
নিদর্শন: প্রাচীন প্রস্তর যুগের নিদর্শন যে সব জায়গায় পাওয়া যায় তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থান হল-
- গুজরাটঃ নর্মদা/তাপ্তি/সবরমতি উপত্যকা
- মধ্যপ্রদেশঃ ভীমবেটকা, আদমগড়
- মহারাষ্ট্রঃ পাটনে, হাতখাম্বা
- কর্নাটকঃ জালালহাল্লি
- রাজস্থানঃ তিলওয়াড়া, বাগোর
- উত্তরপ্রদেশঃ বেলান উপত্যকা, চোপানমান্ডি
- পশ্চিমবঙ্গঃ বর্ধমানের বীরভানপুর
যন্ত্রপাতিঃ- মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষ ছোট ছোট ক্ষুদ্র আকৃতির, মসৃণ, ধারালো ও ব্যবহারের উপযোগী পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করত। এগুলি প্রাণী হত্যার জন্য তৈরি করা হত। এই সময়ের অস্ত্রগুলিকে মাইক্রোলিথ (Microlith) বলা হয়।
জীবনযাত্রাঃ- এই সময় মানুষ নদীর তীরবর্তী অঞ্চল, পাহাড়ের পাদদেশে উন্মুক্ত মালভূমি অঞ্চল ও গুহায় বসবাস করত। এদের স্থায়ী বাসস্থান ছিল না। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে, তারা যাযাবর জীবন যাপন করত। বনের ফল, লতা গুল্ম ও পশুর মাংস খেয়ে তারা জীবন ধারণ করত। এই যুগের মানুষ কৃষিকার্য, পশুপালন ও আগুন জ্বালাতে জানত না। এ যুগের মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রাহক, খাদ্য উৎপাদক নয়।
কুমোরের চাকা আবিস্কার না হওয়ায় হস্ত নির্মিত মাটির পাত্র ব্যবহৃত হত।
নব্য প্রস্তর যুগ(Neolithic Age):-
সময়কাল : আনুমানিক ৬০০০ থেকে ২৫০০ খ্রিস্টপূর্ব
নিদর্শনঃ- প্রাচীন প্রস্তর যুগের নিদর্শন যে সব জায়গায় পাওয়া যায় তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থান হল-
- বালুচিস্তানঃ মেহেরগড়, কিলিগুল মোহাম্মদ, রানাগুন্ডাই, মুন্ডিগাক
- গুজরাটঃ নর্মদা উপত্যকা
- অন্ধ্রপ্রদেশঃ নাগার্জুনকোন্ড
- কর্নাটকঃ হাল্লুর, গণ্ডগীরি, ব্রহ্মগিরি, উত্নুর, টেক্কালকোটা
- কাশ্মীরঃ গুফক্রাল
- তামিলনাড়ুঃ পেটটমপল্লি
- আসামঃ দেওজালি, নাহারকাটিয়া, লোহারঘাট, সারুটারু
- উত্তরপ্রদেশঃ বেলান উপত্যকা, চোপানমান্ডি
- মেঘালয়ঃ পিন্থোরল্যাংটিন
- বিহারঃ তারাদি, চিরান্দ, চেচর, সেনুয়ার
- পশ্চিমবঙ্গঃ পান্ডু রাজার ঢিবি, মহিষাদল, ভারতপুর
যন্ত্রপাতিঃ- নব্য প্রস্তর বা নবপোলিয় যুগের হাতিয়ার গুলি অনেক বেশি মসৃণ, ধারালো ও ব্যবহারে উপযোগী। নব্য প্রস্তর বা নিওলিথিক যুগে হাড়ের তৈরি হাতিয়ার বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। হাড়ের সুচ, বর্শা, ফলা ইত্যাদি হাতিয়ার দেখা যায়।
জীবনযাত্রাঃ-
- নব্য প্রস্তর বা নবপোলিয় যুগের মানুষ ধান, গম ও বার্লি চাষ করত। ভারতীয় উপমহাদেশে কার্পাস উৎপাদনের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায়।
- চাষ আবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে। ছোট ছোট গ্রাম গড়ে ওঠে। মানুষ স্থায়ী বসতি গড়ে তুলতে শুরু করে। এই যুগের মানুষ যেমন পাহাড়ের গুহায় বসবাস করত, তেমনি বসবাসের জন্য চালাঘর নির্মাণ করেছিল। এই সব চালাঘর ছিল কাঠের গুড়ি ও মাটির দেওয়াল ও পেটানো মেঝে। কখনো কখনো মাটির পরিবর্তে একটার পর একটা পাথর দিয়ে দেওয়াল করত। বুজহামের মানুষ মাটির গর্তে বাস করত। নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ স্থাপত্য বা মিনার তৈরী করতে একপ্রকার প্রাচীন পাথর ব্যবহার করা হয় যা মেগালিথ নামে পরিচিত।
- নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ পশুকে পোষ মানাতে শেখে এবং গৃহপালিত পশুর প্রচলন শুরু হয় । মানুষ প্রথম কুকুরকে পােষ মানিয়েছিল। কিন্তু প্রথম গৃহপালিত পশু হল ভেড়া।
- নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখে।
- নব্য প্রস্তর বা নিওলিথিক যুগে কুমােরের চাকা আবিষ্কৃত হয়।
- নব্য প্রস্তর যুগে বেশিরভাগ প্রত্নক্ষেত্র থেকে তামা ও ব্রোঞ্জ এর জিনিস পাওয়া গেছে। মনে করা হয় নব্য প্রস্তর যুগের অন্তত শেষের দিকে ধাতু ব্যবহার শেখে।
- নব্য প্রস্তর যুগের ললিতকলার পরিচয় পাওয়া যায়। পাহাড়ের গায়ে আঁকা চিত্র, পোড়া মাটির মূর্তিতে, পাত্রের গায়ে জ্যামেতিক নকশা, পশু, পাখি, গাছ, ফুল ইত্যাদি আঁকা থাকত। লাল কালো প্রভুতি রঙ দিয়ে মৃৎ পাত্র রাঙানো হত।
Note:-স্যার জন লুবক (Sir John Lubook) নতুন প্রস্তর যুগ কথাটি ব্যবহার করে। ভি গর্ডন চাইল্ড (V.Gordon Childe) নতুন প্রস্তরের সংস্কৃতিকে তাম্র প্রস্তরের সংস্কৃতি বলে বর্ণনা করেছেন। নব্য প্রস্তর যুগে ভারতে তামা ধাতুর ব্যবহার ছিল।
- বুজাহাম (Burzahorm) কথাটির অর্থ জন্মস্থান। এটি অবস্থিত শ্রীনগরে। এখানে কুকুরের সাথে মানুষের সমাধি পাওয়া গেছে।
- কোলডিহা (Koldiha) নামক স্থানে প্রথম ধান চাষের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখানে নব্য প্রস্তর যুগ, তাম্র প্রস্তর যুগ ও লৌহ যুগ এই তিন যুগের সংস্কৃতির নিদর্শন একসাথে দেখা যায়।
- কাশ্মীর উপত্যকার গুফরাল (Gufral) নামক স্থানে প্রাথমিক বাসনপত্রের (Pre Pottery) নিদর্শন পাওয়া গেছে।
- চোপ্রনিমান্ড (Choprimando) নামক স্থানে পৃথিবীর প্রথম বাসনপত্রের (Pottery) নিদর্শন পাওয়া গেছে । এটি বর্তমান বিহারে অবস্থিত ।
- নতুন প্রস্তর যুগে মিলেটের চাষ প্রথম করা হয়েছে দক্ষিণ ভারতে।